সম্প্রতি আবিষ্কৃত হোমো নালেদি প্রজাতির প্রাগৈতিহাসিক মানবেরা আমাদের সরাসরি পূর্বপুরুষ আধুনিক, এমনকি আদি আধুনিক কোনো গোত্রেরও সদস্য নয়। অথচ, তাদের সঙ্গে ‘হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্স’ নামক আমাদের আধুনিক ও বর্তমান প্রজাতির অদ্ভুত মিল রয়েছে।
তবে সবচেয়ে বিষ্ময়কর যেসব সাদৃশ্যের প্রমাণ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা, তার একটি হচ্ছে, কেউ মারা গেলে একটি নির্দিষ্ট গুহায় কবর দেওয়া হতো, অর্থাৎ, সেটি ছিল তাদের কবরস্থান। আবার এমন অন্ধকার ও দুর্গম গুহায় আলো নিয়ে ঢুকেছিল হোমো নালেদিরা। তাইতো মনে করা হচ্ছে, আগুন আবিষ্কার ও নিয়ন্ত্রণেও আনতে পেরেছিল তারা।
হোমো নালেদিদের জীবাশ্ম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রায় ২৮ লাখ থেকে ২৫ লাখ বছর আগে তাদের বিচরণ ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার গুহায়।
প্রায় সাড়ে চার মিলিয়ন বছরের মানব জাতির ইতিহাসে বার বার বিবর্তিত হয়ে সর্বাধুনিক মানুষে পরিণত হওয়া ‘হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্স’ এর উদ্ভবকাল মাত্র ৪৫ হাজার বছর থেকে ৮০ হাজার আগে। আর আমাদের সরাসরি পূর্বপুরুষ হোমো ইরেক্টাস ও হোমো ইরগ্যাস্টারদের স্থায়িত্বকাল ছিল ২৩-২৪ লাখ বছর আগে থেকে শুরু করে আমাদের প্রজাতির উদ্ভবকাল পর্যন্ত। প্রাচীন বুদ্ধিমান মানব প্রজাতি নিয়ান্ডারথাল বা হোমো নিয়ান্ডারথ্যালেন্সিসরাও ৪ লাখ বছর আগে বিবর্তিত হয়ে হারিয়ে গেছে হোমো স্যাপিয়েন্সরা পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর পরই।
যুগে যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে হোমো অস্ট্রালোপিথেকাস অ্যাফারেনসিস্, হোমো হ্যাবিলিস, হোমো এন্টেসেসর, হোমো প্যারানথ্রোপাস্ বোইসেই, হোমো হেইডেলবার্জেন্সিস, হোমো ফ্লোরেসিয়েন্সিস, হোমো রুদোলফেনসিস্, হোমো ডেনিসোভান, হোমো ক্রোম্যাগনন ইত্যাদি প্রজাতিও বিবর্তিত হয়েছে। শারীরিক আধুনিক মানব ও আদি আধুনিক মানবদের আরও কিছু প্রজাতির খোঁজ এখনও মিলছে এবং মিলতেই থাকবে।
তবে সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতি হোমো নালেদিদের আবিষ্কার আমাদের মানব বিবর্তনের লম্বা জটিল পর্যায়ের কিছু শূন্যতা পূরণ করে আরও সমৃদ্ধ করেছে। জীবাশ্ম বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে এদের বেশ কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যও পেয়েছেন।
নতুন আবিষ্কৃত হোমো নালেদির পূর্ণাঙ্গ কঙ্কালের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে দক্ষিণ আফ্রিকার রাইজিং স্টার গুহা শ্রেণীতে প্রায় অক্ষত অবস্থায়। খুবই দুর্গম এই গুহাশ্রেণীর ভেতরের এক জায়গায় একইসঙ্গে প্রায় দেড় হাজার দেহের কঙ্কাল ছিল।
গুহায় ঢোকার মুখ বা দরজা ছিল মাত্র একটাই, তাও আবার মাত্র ১২ মিটার চওড়া। ভেতরে এতোগুলো কঙ্কাল দেখে বিজ্ঞানীরা বলছেন, গুহাটি নালেদিদের কবরস্থান বা সৎকারের জায়গা। গোত্রের সদস্যরা মারা গেলে তাদেরকে এখানে কবর দেওয়া হতো।
এদের হাত ও পায়ের গড়নের সঙ্গেও আধুনিক মানুষ বা আদি-আধুনিক মানুষের অনেক মিল পাওয়া গেছে। উচ্চতাও ছিল প্রায় পাঁচ ফিট, যা আমাদের গড় উচ্চতার কাছাকাছি। ধারণা করা হচ্ছে এরা প্রজাতি হিসেবে আমাদের কাছাকাছি ছিল।
অথচ তাদের ধড় ও কাঁধের গড়ন পুরনো প্রজাতিগুলোর সঙ্গে বেশি মিলে যায়। এমন ছোট কাঁধ নির্দেশ করে যে তারা কোনো গাছ, পাহাড় বা উঁচু স্থানে উঠতে পারদর্শী ছিল।
এদের মস্তিষ্কের আকার ছিল অনেক ছোট, মাত্র ২৭ থেকে ৩৪ ঘনইঞ্চি। এটিও অস্ট্রালোপিথেকাস বা সবচেয়ে পুরনো হোমিনিনদের সঙ্গে বেশি মিলে যাচ্ছে।
মূলত মগজের এমন ছোট আকার দেখেই বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত যে, হোমো নালেদি বেশ পুরনো প্রজাতি, আজ প্রায় ২৮ লাখ থেকে ২৫ লাখ বছর আগে তাদের বিচরণ ছিল।
এত পুরনো প্রজাতি অথচ হাত-পায়ের গড়ন আমাদের কাছাকাছি, এমনকি তাদের নিজস্ব সৎকার প্রথাও ছিল- এ বিষয়টিই বেশি বিষ্ময়কর। হোমো নালেদিরা এমন অন্ধকার ও দুর্গম গুহায় নিশ্চয়ই আলো নিয়ে ঢুকেছিল। এটি বলছে, সে সময়ে আগুনের নিয়ন্ত্রণও এসেছিল!
আবার হোমো নালেদিদের বিলুপ্তির অনেক পরে (১৭ থেকে ১৫ লাখ বছর আগে) হোমো ইরেক্টাস ও ইরগ্যাস্টার থেকে কাছাকাছি ধরনের হোমিনিনরা অভিবাসন শুরু করে। প্রায় সব প্রজাতিরই আফ্রিকায় উদ্ভব ঘটেছে, তারপর আফ্রিকার ক্রান্তীয় অঞ্চল, ইউরোপ, দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছে। আবার অন্য স্থান থেকেও উৎপত্তি লাভ করে পরিবেশ বা খাদ্যের খোঁজে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যেতে থাকে।
এক প্রজাতি অন্য প্রজাতির সংস্পর্শে এসে কিংবা পরিবেশ বদলানোর ফলে সমসাময়িক অনেকগুলো প্রজাতি তৈরি হয়েছে। এরা খুবই কাছাকাছি ধরনের, কিন্তু শরীরবিদ্যা, হাড়ের গড়ন, অস্ত্রশস্ত্র ও সংস্কৃতিতে অনেক আলাদা। একই সময়ে বিভিন্ন প্রজাতিগুলো পাশাপাশি অবস্থান করেছে, মারামারি করেছে এমন নিদর্শনও পাওয়া গেছে।
হোমো নালেদিরা যেহেতু অভিবাসনকারী মানব গোত্র নয়, সেহেতু পাথর-আগুনের ব্যবহার বা সৎকার প্রথা অন্য কারো কাছ থেকে পায়নি, এটিও নিশ্চিত। আবার এতোদিনকার ধারণা ছিল, এসবের সূচনা ঘটেছে আরও অনেক পরে থেকে (প্রাথমিক প্লেইস্টোসিন সময়ে আদি আধুনিক প্রজাতির মানুষদের থেকে)।
তাই বিষ্ময়কার এ আবিষ্কার বা হোমো নালেদিরা মানব বিবর্তনের নতুন ইতিহাস তৈরি করবে বলেই ভাবাচ্ছে বিজ্ঞানীদের।